ইতিহাস বই আলোচনা

ইলা মিত্রের হাসপাতালের দিনগুলো

১৯৫৩ সালে তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্রকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাখা হয়। ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিকের সহায়তায় স্বামী রমেন মিত্র সে সময় দেখা করেন তাঁর সঙ্গে। আহমদ রফিক সেই স্মৃতি লিখেছেন ইলা–রমেন কথা: প্রাসঙ্গিক রাজনীতি শিরোনামের বইয়ে। পরে এটি মালেকা বেগমের ইলা মিত্র: নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী বইয়ে ‘পথ চলতে যা দেখেছি এবং ইলা-রমেন কথা’ নামে সংকলিত হয়েছে।

আহমদ রফিক

প্রথমেই বলে রাখি, এ রচনা নাচোলে সংঘটিত তেভাগা আন্দোলনের প্রথাসিদ্ধ ইতিহাস নয়; নয় ইলা-রমেনের পূর্ণাঙ্গ জীবনকাহিনি। এ রচনা মূলত ইলা মিত্র, রমেন মিত্রের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে তাঁদের নিয়ে স্মৃতিচারণা।

আমি তখন বাম রাজনীতিতে গভীরভাবে মগ্ন, বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা এক তরুণ ছাত্র, শিক্ষাজীবন ও পড়াশোনা যার কাছে তখন বাহুল্যমাত্র। অথচ বিশ্বসাহিত্য ও মার্ক্সবাদী রচনাপাঠে প্রবল আগ্রহ।

এমন এক পরিস্থিতি ও পরিবেশে ইলা মিত্র ও রমেন মিত্রের সঙ্গে আমার পরিচয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। প্রথমজন গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, দ্বিতীয়জন আত্মগোপনে, মাথার ওপর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। রাজশাহী থেকে চলে এসেছেন ঢাকায়, গোপনে ইলা মিত্রের মামলা পরিচালনার সুবাদে এবং হাসপাতালে ইলা মিত্রের দেখা–সাক্ষাতের প্রয়োজনে।

দ্বিতীয় প্রয়োজনের দায় যথাযথ সম্পন্ন করতে জেলা পার্টির নেতৃত্ব আমার সর্বাঙ্গীণ সাহায্য চেয়েছে। সে সাহচর্য প্রধানত রাজনৈতিক, যা নিত্যদিনের ঘটনায় ব্যক্তিক সম্পর্কে পৌঁছে যায়।

পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিককার কথা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ২০ নম্বর ব্যারাকের ৬ নম্বর রুমে বসে আছেন আত্মগোপনে থাকা কমিউনিস্ট নেতা (রাজশাহীর নাচোল এলাকার কৃষকনেতা) রমেন মিত্র। বেশ কিছুদিন থেকে এ রুমে তাঁর যাতায়াত। উদ্দেশ্য একটাই—মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি গুরুতর অসুস্থ স্ত্রী ইলা মিত্রের সঙ্গে রাতে একবার দেখা করা। এ দেখা করার পাট চলছে বেশ কিছুদিন ধরে।

আসছেন রীতিমতো ঝুঁকি নিয়ে। কারণ, তাঁর নামেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। ধরা পড়লে সমূহ বিপদ। তবু আসছেন এবং তা পার্টির মতামত সাপেক্ষে। পার্টি নেতৃত্বের ভাবনা, তাঁদের দেখা–সাক্ষাৎ ইলা মিত্রের সুস্থ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও সহায়তা করবে। তাই কমিউনিস্ট পার্টির ঢাকা জেলা কমিটির পক্ষ থেকে এ ব্যবস্থা।

সময়টা ১৯৫৩ সালের নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি।… জনৈক পার্টি নেতার অনুরোধে ইলা মিত্রের দায়টা আমার কাঁধেই থাকে।… সমস্যা ছিল ইলা মিত্রকে নিয়ে। গুরুত্বপূর্ণ মামলার অন্তভু৴​ক্ত, ফ্যাসিস্ট লীগ সরকারের হাতে নির্যাতিত, সারাক্ষণ শয্যার পাশে পুলিশ পাহারা, হাসপাতালজুড়ে আলোচনা। প্রফেসর কে এম আলমের অধীন তাঁর চিকিৎসা ভালোভাবেই চলছে। প্রথম দিন ইলা মিত্র কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থেকে খুব মৃদুকণ্ঠে বললেন, ‘আপনার জন্য কদিন ধরে অপেক্ষা করছি।’ আবার তেমনি নিস্তেজ গলায় জানালেন, ‘আপনাকে কানুর মতো লাগছে।’ অবাক হয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকাতেই বললেন, ‘কানু, ওই যে আমার ছোট ভাই।’ এবার বোঝা গেল। আশ্বাস দিয়ে বলি, ‘কিচ্ছু ভাববেন না। এখানে সবাই আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী, ঠিক ভালো হয়ে যাবেন।’

সে রাতে ঘরে ফিরে সদ্য কেনা খাতার পাতায় ক্লাসনোটের বদলে দিনপঞ্জি লেখা শুরু করি। জীর্ণ খাতার লেখাগুলো কিছুটা ঝাপসা হলেও এখনো পড়তে পারা যায়।

প্রথম সাক্ষাতের দিনটা ছিল ৩ অগ্রহায়ণ, ১১ নভেম্বর ১৯৫৩ সাল। ওই দিনপঞ্জি থেকে কিছুটা তুলে দেওয়া যেতে পারে এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে।…ছয় দশক পর এ লেখা পড়তে পাঠকের মজা লাগবে ধরে নিয়ে কিছুটা হুবহু তুলে দিচ্ছি: ‘কিছুদিন হলো পাখিদি এসেছেন এখানে। এর আগে দেখিনি তাঁকে। এ যে দেখছি দিব্যি তরুণী। সাধারণ্যে প্রচুর সহানুভূতি পাচ্ছেন। শুনলাম ওর জীবনের কথা। বীরাঙ্গনা, সন্দেহ নেই এতটুকু। গভীর দীঘল চোখ। বরিন্দের রোদে জ্বলা বাদামি চামড়া, তবু আশ্চর্য রকম সুশ্রী।’

বলার অপেক্ষা রাখে না যে ‘পাখি’ ছদ্মনাম ইলাদির, ‘রমেন’ রমজান ভাইয়ের নাম।

এক সন্ধ্যায় রমেন মিত্র এলেন, পরিচয় ‘রমজান ভাই’। আমিও নিয়মমাফিক আসল নাম জানতে চাইনি, যদিও পরিচয় অজানা ছিল না। বললেন, ওই টেকনামেই যেন তাঁকে ডাকি। সেই থেকে ‘রমজান ভাই’ নামটাই আমার মাথায় গেঁথে আছে, পরবর্তী কয়েক মাসের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যের কারণে। এখন ‘রমেনদা’ শব্দটা কেমন যেন অচেনা ঠেকে। রমজান ভাইয়ের মনে আছে কি না, জানি না, ইলা মিত্রের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের রাতে তাঁর হাতে ছিল রজনীগন্ধার ডাঁটা। তাঁকে ইলাদির শয্যার পাশে পৌঁছে দিয়ে করিডরে গিয়ে দাঁড়াই। প্রথম সাক্ষাৎ বলে কথা। কিন্তু ইলাদির জবরদস্তিতে সাক্ষাতের গোটা সময়টা পাশে দাঁড়িয়ে থেকেছি, অবশ্য অস্বস্তি নিয়ে এবং একটু দূরত্ব রেখে। তবু বরাবর চোখে পড়েছে, মানুষটা কাছে আসতেই ইলাদির ফ্যাকাশে মুখে লালচে ছোপ।

তাঁদের প্রথম সাক্ষাতের কথা আমার ডায়েরিতে: ‘আজ রমেন এল, হাতে রজনীগন্ধার শ্যামল ডাঁটা। একদিন পাখিদির দেহকান্তি ও মনের সৌন্দর্য জয় করেছিল কাব্যরসিক, তীক্ষ্ণ নাসা, কোনো এক দীঘল দেহ যুবকের মন। আজ আমার মনে হচ্ছে শুধু একটি কথা; “কাব্য নয়, চিত্র নয়, প্রতিমূর্তি নয়। ধরণী চাহিছে শুধু হৃদয়, হৃদয়।” পাখিদি যেদিন, অর্থাৎ প্রথম দিন লজ্জা আর কুণ্ঠা মিশিয়ে অস্ফুট কণ্ঠে রমেনের সংবাদ জানতে চাইলেন, তাঁর নতমুখী চেহারাটা ভারি সুন্দর দেখাচ্ছিল, ছবি তুলে রাখতে পারলে ভালো হতো। আমার তো আবার ক্যামেরা নেই।’

এরপর নিয়মিত এসেছেন রমজান ভাই। ঘরে ঢুকেই একটা সিজার সিগারেট ধরিয়ে নিঃশব্দে কিছুক্ষণ টানা, তারপর প্রায়ই গুনগুন করে কবিতা আবৃত্তি। হয় ‘প্রথমা’র কবি প্রেমেন মিত্রের: ‘আমি কবি যত কামারের আর কাঁসারির আর ছুতোরের, মুটে মজুরের’, না হয় সুভাষ মুখার্জির: ‘এ দেশ আমার গর্ব/ এ মাটি আমার কাছে সোনা’, অথবা সুকান্তের: ‘চলে যাবো তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ…।’ আর রবীন্দ্রনাথ হলে শুরুতে: ‘রূপনারানের কূলে জেগে উঠিলাম’, পরে ‘মহুয়া’ বা শেষের কবিতা থেকে।

তাঁকে দেখে দেখে বারবার মনে হয়েছে, এমন একজন রোমান্টিক, কাব্যরসিক ইন্টেলেকচুয়ালের পক্ষে কমিউনিস্ট পার্টির কৃষক আন্দোলনের নেতা হওয়া কীভাবে সম্ভব! তা-ও আবার বিপজ্জনক তেভাগা আন্দোলনের? একমাত্র রোমান্টিক অ্যাডভেঞ্চারের টানেই বুঝি তা সম্ভব।

আর একই কারণে মাথার ওপর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাসপাতালে অসুস্থ স্ত্রীকে দেখতে আসা তাঁর পক্ষে মোটেই অস্বাভাবিক ছিল না। এ-ও একধরনের অ্যাডভেঞ্চারিজম। আর সে অ্যাডভেঞ্চারের নায়ক রমেন মিত্র। পরে একদিন কথাগুলো বলতেই আঙুলের ফাঁকে সিগারেট চেপে রমজান ভাই সশব্দ হাসিতে বলে ওঠেন, ‘ওই, কী ফাজিল ছেলে রে বাবা।’(…)

‘তুই তো দেখিসনি বেথুনের ছাত্রী ইলা সেনকে। কী দুর্দান্ত স্মার্ট, খেলাধুলায় এক্সপার্ট এক অ্যাথলেট, সবার চোখে আকর্ষণীয় এক তরুণী। তার কিনা বিয়ে হলো ঢ্যাঙা হাবুল মিত্তিরের সঙ্গে!’ তক্তপোষে জুতসই হয়ে বসে ডান হাতের দুই আঙুলে ধরা ‘সিজার’ সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে, চোখেমুখে একচিলতে হাসি নিয়ে সরস ভঙ্গিতে মজা করে কথাগুলো বলেছিলেন রমেন মিত্র, যিনি টেকনামে ‘রমজান ভাই’। ছদ্মনাম আত্মগোপনে থাকা কমিউনিস্ট নেতাদের পরিচয় গোপন রাখার এ এক বরাবরের পদ্ধতি।

…মাঘের ১০ তারিখ। ইলাদি সম্পর্কে ডায়েরিতে লেখা, ‘খাঁচায় আটকে থেকে পাখি শুকিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।’ মনে হয়, মানসিক উদ্বেগ-অশান্তির কারণে ইলাদির স্বাস্থ্য আশানুরূপ ভালো হচ্ছে না। অথচ ডাক্তার-নার্সদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই। এর মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির উপর মহলের সিদ্ধান্তক্রমে ইলা-রমেনের একমাত্র সন্তান মোহনকে ঢাকায় আনা হয়েছে তাঁর মা-বাবার সঙ্গে, বিশেষ করে মায়ের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য। কাজটা ছিল খুবই ঝুঁকির। তবু পরিবেশ অনুকূল বলেই বোধ হয় ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এক সন্ধ্যায় ছোট্ট মোহনকে আমার ঘরে নিয়ে আসা হলো। যতদূর মনে পড়ে, তার মামা বা অনুরূপ কেউ সঙ্গে ছিলেন। হাসপাতালে মায়ের সঙ্গে সাক্ষাতের ওই ১০ তারিখের ডায়েরিতে এ সম্পর্কে মাত্র কয়েকটা বাক্য, ‘মোহন এসেছিল। সুন্দর ফুটফুটে বালক। চোখে-মুখে কথা। কী চঞ্চল আর কী দুষ্টু! মনে হয় ও সব জানে, সব বোঝে। মায়ের বুক ফেটে যেতে চায় ছেলেকে সারাক্ষণ কাছে না পেয়ে।’

সত্যি মোহনকে দেখে ইলাদি কিছুটা অভিভূত হয়ে পড়েন। তবে একটু পরই নিজেকে সামলে নেন। ছেলে, স্বামী, পারিবারিক ভাবনা নিয়ে বিচলিত হয়েছিলেন বলেই কি না, জানি না। দিন কয়েক পর (১৫ মাঘ) হঠাৎই আমাকে প্রশ্ন করেন, ‘আচ্ছা বলুন তো, এত ঘটনার পর মানুষ কি আমাকে আগের মতো করে দেখতে পারবে?’ কথা শুনে অবাক হই। মানুষ মানে তো সমাজ। এমন পোড় খাওয়া, কঠিন ধাতুতে গড়া কৃষকনেত্রীর পক্ষে সমাজ নিয়ে এমন ভাবনা কীভাবে সম্ভব? আমার মতো করে যুক্তি দিয়ে তাঁর দুর্ভাবনা উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করি। ইলাদি নিঃশব্দে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। সে রাতেই ডায়েরিতে লিখি, ‘কত দুর্বল যে মেয়েদের মন! নইলে অমন দৃঢ়চেতা মেয়েও বিশেষ এক জায়গায় অদ্ভুত রকম স্পর্শকাতর হন কেমন করে? সমাজটা এখনো এমনই যে সংস্কারের ছাপ চেতনা থেকে মুছে ফেলার পরও কিছুটা বুঝি থেকেই যায়। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে কত যুগ লাগবে কে জানে।’

About the author

Prothoma

লিখতে ভালোবাসি, কারণ- আমি উড়তে ভালোবাসি। একমাত্র লিখতে গেলেই আসমানে পাখা মেলা যায়। আমার জন্ম কোথায়, পূর্ণ নাম কী, কোথায় কিসে পড়াশোনা করেছি, এটুকু আমার পরিচয় নয়। যেটুকু আমাকে দেখা যায় না, সেটুকুই আমার পরিচয়। বাকিটুকু আমার চিন্তায় ও সৃষ্টিকর্মে।

Add Comment

Click here to post a comment