বই আলোচনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

বাঙালি বিজ্ঞানীর বিশ্বজয়

চায়ের নিমন্ত্রণ করলেন আইনস্টাইন। ১৪ সেপ্টেম্বর বিকেলে বার্লিনের কাপুথে বিজ্ঞানীর বাড়ি ‘আইনস্টাইন ভিলা’য় গেলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শুরুতে ভাষা নিয়ে আলোচনায় একধরনের জটিলতা দেখা দিল দুই মনীষীর। আইনস্টাইনের মাতৃভাষা জার্মান, ভালো ইংরেজি জানেন না। রবীন্দ্রনাথ আবার ইংরেজিটা ভালো জানলেও জার্মান ভাষা বোঝেন না একবিন্দু। তাই দোভাষীর সহায়তা নিলেন তাঁরা। দেখা গেল, জগৎ–সংসার নিয়ে চিন্তাভাবনায় দারুণ মিল দুজনের। তাই ঘনিষ্ঠতা হতে বেশি সময় লাগল না।

আবুল বাসার

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বের হয়েছেন বিশ্বভ্রমণে। বহু দেশ ঘুরে পা রেখেছেন জার্মানিতে। রাজধানী বার্লিনে। সেখানে দেখা হলো বিজ্ঞানজগতের তারকা আলবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে। ১৯২৬ সালের কথা সেটা। দুজনই তখন নোবেলজয়ী।

চায়ের নিমন্ত্রণ করলেন আইনস্টাইন। ১৪ সেপ্টেম্বর বিকেলে বার্লিনের কাপুথে বিজ্ঞানীর বাড়ি ‘আইনস্টাইন ভিলা’য় গেলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শুরুতে ভাষা নিয়ে আলোচনায় একধরনের জটিলতা দেখা দিল দুই মনীষীর। আইনস্টাইনের মাতৃভাষা জার্মান, ভালো ইংরেজি জানেন না। রবীন্দ্রনাথ আবার ইংরেজিটা ভালো জানলেও জার্মান ভাষা বোঝেন না একবিন্দু। তাই দোভাষীর সহায়তা নিলেন তাঁরা। দেখা গেল, জগৎ–সংসার নিয়ে চিন্তাভাবনায় দারুণ মিল দুজনের। তাই ঘনিষ্ঠতা হতে বেশি সময় লাগল না।

বিচিত্র বিষয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে যাচ্ছেন দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা। ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান—বাদ যাচ্ছে না কোনো কিছুই। কথার একফাঁকে আইনস্টাইন হঠাৎ ভারতীয় এক বিজ্ঞানীর কথা জিজ্ঞেস করেন রবীন্দ্রনাথকে। আইনস্টাইনের চোখে তিনি বিশিষ্ট বিজ্ঞানী। কিন্তু কবি চিনতে পারলেন না নিজ দেশের সেই বিজ্ঞানীকে। আইনস্টাইন কার কথা বলছেন? কে এই বিজ্ঞানী?

কলকাতায় ফিরে খোঁজখবর করলেন। জানতে পারলেন, তিনি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। দেশের মানুষেরা তাঁকে না চিনলেও ইউরোপের বিজ্ঞানীরা, বিশেষ করে কোয়ান্টাম মেকানিকস নিয়ে যাঁদের কারবার, তাঁরা তাঁকে একনামে চেনেন—সত্যেন বোস নামে। সব শুনে লজ্জায় মাথা কাটা গেল বিশ্বকবির। প্রায়শ্চিত্ত করতে মনস্থির করলেন। সমসাময়িক বিজ্ঞানের বই ঘেঁটে লিখলেন একটি বই। তাঁর লেখকজীবনের একমাত্র বিজ্ঞানের বই। নাম বিশ্বপরিচয়। বইটি এখন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানবিষয়ক বইয়ের মধ্যে ক্ল্যাসিক হিসেবে গণ্য। সেটা উৎসর্গও করলেন সত্যেন বোসের নামে। সঙ্গে লিখলেন দীর্ঘ এক ভূমিকা। কিন্তু কী এমন কাজ করেছিলেন সত্যেন? তাঁর কী এমন অবদান যে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আইনস্টাইনও তাঁর নাম নেন শ্রদ্ধার সঙ্গে? তাঁকে না চেনার অপরাধে বিজ্ঞানের বই লেখেন খোদ রবীন্দ্রনাথও?

১৯২৪ সাল। ইউরোপে তখন চলছে কোয়ান্টাম উন্মাদনা। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন আইনস্টাইন। সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রকাশ করে সারা বিশ্বে হইচই বাধিয়ে দিয়েছেন তিনি। প্রতিদিনই গাদা গাদা চিঠিপত্র আসে বিজ্ঞানীর কাছে। ছেলে থেকে বুড়ো—সবারই তাঁর তত্ত্ব নিয়ে আগ্রহ, নানা জিজ্ঞাসা। মাঝেমধ্যে আজেবাজে চিঠিও আসে। প্রায় সবই খুঁটিয়ে পড়েন আইনস্টাইন। প্রয়োজনে চিঠি লিখে তার জবাবও দেন।

একদিন এমনই একটা চিঠি এল তাঁর কাছে। এসেছে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষ থেকে। প্রেরক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামান্য এক রিডার—সত্যেন বোস। চিঠির সঙ্গে রয়েছে এক গবেষণাপত্র। বেশ কয়েক পাতার। চিঠিতে অনুরোধ করা হয়েছে, সেটা জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে জার্মানির কোনো জার্নালে যেন ছাপানোর ব্যবস্থা করেন আইনস্টাইন। অদ্ভুত আবদার! এ রকম চিঠি আর গবেষণাপত্র আপেক্ষিকতার জনকের কাছে মাঝেমধ্যই আসে। সেগুলোর বেশির ভাগেরই জায়গা হয় ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে। বোসের গবেষণাপত্রটা যে সেখানেই ছুড়ে ফেলা হবে, তাতে আর সন্দেহ কী! তার আগে একবার চোখ বুলিয়ে দেখতে চাইলেন আইনস্টাইন।

অবিশ্বাস্য! কোয়ান্টাম তত্ত্বের বহুদিনের একটা সমস্যা পরিসংখ্যান দিয়ে সমাধান করেছে ‘ছোকরা’। এ রকম এক সমাধানই তো অনেক দিন ধরে খুঁজছেন তিনিসহ কোয়ান্টাম বিজ্ঞানীরা। সেটা কিনা করেছে অখ্যাত এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অখ্যাত এক শিক্ষক! অবাক হন তিনি। গবেষণাপত্রের গুরুত্ব বুঝে বোসের অনুরোধটা সত্যিই রক্ষা করলেন আইনস্টাইন। নিজেই সেটা জার্মান ভাষায় অনুবাদ করলেন। তারপর পাঠিয়ে দিলেন জার্মানির বিখ্যাত জার্নাল সাইটস্রিফট ফ্যুর ফিজিক-এ। সঙ্গে নোটও পাঠালেন, বোসের এ কাজটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

১৯২৪ সালের জুনে তা জার্নালে প্রকাশ পেল। বোসের নাম ছড়িয়ে পড়ল পুরো ইউরোপে। মজার ব্যাপার হলো, তত্ত্বটার সঙ্গে আইনস্টাইনের নামও জুড়ে গেল। সেটা দাঁড়াল: বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিকস। এর ওপর ভিত্তি করে কোয়ান্টাম জগতে শুরু হলো আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা। তার মধ্যে একটা বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট। কিন্তু কী সেটা? আধুনিক বিজ্ঞানে কেনই বা সেটা এত গুরুত্বপূর্ণ? এত সব নিয়ে বাংলা ভাষায় বিস্তারিত কোনো বই এতকাল ছিল না। সেই অভাব পূরণ করলেন সুলেখক আবদুল গাফফার। যাঁরা সহজভাবে বিজ্ঞান বুঝতে চান, তাঁদের কথা মাথায় রেখে লেখেন তিনি। তাঁর ভাষা সহজ-সরল। ঢংটা গল্প বলার। সেই সরলতাকে পুঁজি করে খুব সহজেই কৌতূহলী পাঠককে টেনে নিয়ে যান বিষয়ের গভীরে। তাই বিজ্ঞানের রোমাঞ্চকর জগতে পাড়ি দিয়ে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞান বুঝতে পাঠকের বাকি থাকে না। এ বইতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উদাহরণ ও উপমা ব্যবহারের কারণে পাঠক বিষয়ের একদম গভীরে ঢুকে যেতে পারবেন অনায়াস। তবে বইটিতে কিছু মুদ্রণ প্রমাদ রয়ে গেছে। পরবর্তী সংস্করণে সেগুলো সংশোধন করার অনুরোধ থাকল লেখকের কাছে।

About the author

Prothoma

লিখতে ভালোবাসি, কারণ- আমি উড়তে ভালোবাসি। একমাত্র লিখতে গেলেই আসমানে পাখা মেলা যায়। আমার জন্ম কোথায়, পূর্ণ নাম কী, কোথায় কিসে পড়াশোনা করেছি, এটুকু আমার পরিচয় নয়। যেটুকু আমাকে দেখা যায় না, সেটুকুই আমার পরিচয়। বাকিটুকু আমার চিন্তায় ও সৃষ্টিকর্মে।

Add Comment

Click here to post a comment